ঘুম কেন দরকার? ঘুমের উপকারিতা, ঘুম না আসার কারণ ও প্রাকৃতিক সমাধান
![]() |
ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার |
লেখা: স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি ডায়েরি
রাত পেরিয়ে যাচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, কিন্তু চোখে ঘুম নেই। একবার ডান দিকে, একবার বাঁ দিকে—চুপচাপ শুয়ে আছেন, অথচ ঘুম আপনাকে ছোঁয় না। এই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই হয়। নিয়মিত ঘুম না হলে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মন বিষণ্ণ হয়ে যায়, এবং পরের দিনের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
তাহলে প্রশ্ন হলো—ঘুম না আসলে কী করবেন? চলুন জেনে নেই কিছু কার্যকরী ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়।
🧠 কেন ঘুম আসে না?
ঘুম আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক চক্র—যাকে বলে সারকেডিয়ান রিদম (Circadian Rhythm)। এই ঘড়ির ওপর প্রভাব ফেলে—
•অতিরিক্ত আলো (বিশেষ করে মোবাইল/ল্যাপটপের)
•দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ
•অনিয়মিত ঘুমানোর সময়
•কফি বা চা বেশি খাওয়া
•ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের অভাব
🌟 মেলাটোনিন—ঘুমের জাদুকর হরমোন
আমাদের শরীর সূর্য ডুবার পর স্বাভাবিকভাবে মেলাটোনিন হরমোন তৈরি করে, যা ঘুমের সংকেত দেয়। কিন্তু মোবাইল, ল্যাপটপের আলো ও দুশ্চিন্তা এই প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
🛌 ঘুম দরকার কেনো?
ঘুম শুধুই বিশ্রাম নয়, এটি শরীর ও মনের পুনর্গঠনের সময়। ঘুমের গুরুত্ব অসীম — কারণ এটি:
🔹 মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করে
ঘুমের সময় মস্তিষ্ক দিনের তথ্য গুছিয়ে রাখে, স্মৃতি সংরক্ষণ করে এবং অপ্রয়োজনীয় তথ্য বাদ দেয়।
🔹 শরীরের কোষ মেরামত করে
ঘুমের সময় শরীর নিজের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ ও টিস্যু মেরামত করে।
🔹 ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে
পর্যাপ্ত ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।
🔹 মন-মেজাজ ঠিক রাখে
ঘুম কম হলে আপনি সহজেই রেগে যান বা বিষণ্ণ বোধ করেন। ঘুম মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
🔹 শিখতে ও মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে
ছাত্রদের জন্য ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এটি শেখার ক্ষমতা ও মনোযোগ উন্নত করে।
🔹 হার্ট ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
ঘুমের সময় হৃদপিন্ড বিশ্রাম পায় এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
🔹 হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে
ঘুম খিদে নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন (লেপটিন ও ঘ্রেলিন), ইনসুলিন, ও স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।
আরো জানুন: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সহজ, প্রাকৃতিক ও কার্যকর উপায়
✅ কী করবেন ঘুম না আসলে?
১. ঘুমের আগে "মাইন্ডফুলনেস" বা ধ্যান
শুধু আপনি চোখ বন্ধ করে ১০ মিনিট ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিন এবং মনোযোগ দিন নিজের নিঃশ্বাসে। একে বলে mindful breathing বা মেডিটেশন—যেটা ঘুম আনার জন্য খুব কার্যকর।
২. মেলাটোনিন-বুস্টিং খাবার খান রাতে
🥛 গরম দুধ (ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড মেলাটোনিন তৈরি করে)
🍌 কলা (ম্যাগনেশিয়াম ও পটাসিয়াম ঘুমে সহায়ক)
🌾 ওটস
🌰 বাদাম
৩. ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন সন্ধ্যার পর
চা, কফি বা চকলেট—এসব খাবারে থাকে ক্যাফেইন, যা আপনার স্নায়ুকে উত্তেজিত করে এবং ঘুম আসতে দেয় না। চেষ্টা করুন সন্ধ্যার পর এগুলো না খেতে। তার বদলে গরম দুধ, তুলসী চা, অথবা ক্যামোমাইল চা খেতে পারেন—যেগুলো ঘুমের সহায়ক।
৪. স্ক্রিন বন্ধ করুন – “ডিজিটাল ডিটক্স”
ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপ বন্ধ করুন। নীল আলো (blue light) মেলাটোনিনের ক্ষতি করে।
৫. গরম পানির গোসল – ম্যাজিকাল রিল্যাক্সেশন
গরম পানি স্নায়ুকে শিথিল করে। রাতে গোসল করলে শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে, যা মস্তিষ্কে ঘুমের সংকেত দেয়।
৬. একই সময়ে ঘুমানো ও জাগা – শরীরকে শিখিয়ে দিন
ঘুমের রুটিন ঠিক করুন। এমনকি ছুটির দিনেও। এতে আপনার শরীর স্বাভাবিকভাবে ওই সময়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
৭. ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিন—আজকের শান্তি নিয়ে ভাবুন
অনেক সময় ঘুম না আসার কারণ হলো মাথায় হাজারো চিন্তা। “কাল কী করবো?”, “বস কী বলবে?”, “টাকা কিভাবে আসবে?” ইত্যাদি। এসব চিন্তা আপনি সকালে ঘুমিয়ে উঠে করলেই ভালো। রাতে শুধু ভাবুন—“এই মুহূর্তটা আমার বিশ্রামের, আর কিছু নয়।”
💤 শেষ কথায়…
ঘুম হচ্ছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধুই বিশ্রাম নয়, বরং মস্তিষ্কের "রিফ্রেশ" বোতাম। ঘুম না আসা মানে শরীরের সংকেত—আপনার রুটিনে কিছু ঠিক নেই। সেই সংকেতকে গুরুত্ব দিন। আর আজ রাতেই নিজের জন্য তৈরি করুন একটি শান্তিপূর্ণ ঘুমের রুটিন।
কোন মন্তব্য নেই