পেসমেকার কী? এটি কীভাবে কাজ করে ও কাদের ব্যাবহার করতে হয়? বিস্তারিত জানুন

হৃদযন্ত্রে পেসমেকার: চিকিৎসা প্রযুক্তির অনন্য অবদান

আমাদের হৃদপিন্ড নিজেই একটি স্বয়ংক্রিয় ছন্দে স্পন্দিত হয়ে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে। কিন্তু কখনও কখনও এই ছন্দে ব্যাঘাত ঘটে, যার ফলে হৃদস্পন্দন খুব ধীর বা অনিয়মিত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হয় একটি যন্ত্রের আর তা হলো পেসমেকার।


পেসমেকার কী?

পেসমেকার একটি ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক ডিভাইস যা হৃদপিণ্ডের স্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সাধারণত রোগীর বুকে ত্বকের নিচে প্রতিস্থাপন করা হয় এবং এর থেকে বের হওয়া তারের (lead wire) মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়।

এই ডিভাইসটি বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠিয়ে হৃদপিণ্ডের গতি (rate) এবং ছন্দ (rhythm) স্বাভাবিক রাখে।


পেসমেকার কত প্রকার?

পেসমেকার মূলত তিন প্রকারের হয়ে থাকে:

১. সিঙ্গেল-চেম্বার পেসমেকার (Single-Chamber Pacemaker): এই পেসমেকার শুধুমাত্র হৃদপিণ্ডের একটি চেম্বার (সাধারণত ডান অলিন্দ বা ডান নিলয়) নিয়ন্ত্রণ করে।

২. ডুয়াল-চেম্বার পেসমেকার (Dual-Chamber Pacemaker): এটি হৃদপিণ্ডের দুটি চেম্বার (ডান অলিন্দ এবং ডান নিলয়) নিয়ন্ত্রণ করে, যা হৃদপিণ্ডের প্রাকৃতিক ছন্দের সাথে আরও ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৩. বাই-ভেন্ট্রিকুলার পেসমেকার বা সিআরটি (Biventricular Pacemaker or CRT - Cardiac Resynchronization Therapy): এটি হৃদপিণ্ডের তিনটি চেম্বার (ডান অলিন্দ, ডান নিলয় এবং বাম নিলয়) নিয়ন্ত্রণ করে। গুরুতর হার্ট ফেইলিউরের রোগীদের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়, যেখানে হৃদপিণ্ডের দুটি নিলয় একসাথে সংকুচিত হয় না।


পেসমেকারের কাজ কী?

পেসমেকারের প্রধান কাজ হলো হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক ধীর গতি বা অনিয়মিত স্পন্দনকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনা। এটি নিচের কাজগুলো করে থাকে:

• হৃদস্পন্দনের হার খুব কমে গেলে তা বাড়িয়ে দেয়

• অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ঠিক করে

• হৃদপিণ্ডের সংকোচনের সঠিক ছন্দ বজায় রাখে

• হঠাৎ করে হৃদপিন্ড থেমে গেলে তা চালু করে


পেসমেকার কিভাবে কাজ করে?

একটি পেসমেকারে সাধারণত দুটি প্রধান অংশ থাকে:

১. পালস জেনারেটর (Pulse Generator): এটি একটি ছোট ধাতব বাক্স, যার মধ্যে একটি ব্যাটারি এবং একটি ক্ষুদ্র কম্পিউটার সার্কিট থাকে। এই অংশটি বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে।

২. লিডস (Leads): এগুলি হলো পাতলা, নমনীয় তার, যা পালস জেনারেটর থেকে হৃদপিণ্ডের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই তারগুলি হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ সনাক্ত করে এবং পালস জেনারেটর থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত হৃদপিণ্ডে পৌঁছে দেয়।


যখন হৃদপিণ্ড খুব ধীরে স্পন্দিত হয় বা স্পন্দন ছেড়ে দেয়, তখন পেসমেকার তা সনাক্ত করে এবং লিডসের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে একটি ছোট বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়, যা হৃদপিণ্ডকে আবার স্বাভাবিকভাবে স্পন্দিত হতে সাহায্য করে।

আরো জানুন: ব্লু-লাইট কী? চোখের ক্ষতি ও প্রতিকার | ব্লু-লাইট থেকে চোখ রক্ষার উপায়।


কাদের পেসমেকার লাগাতে হয়?

সাধারণত নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে রোগীদের পেসমেকার লাগানোর প্রয়োজন হতে পারে:

ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Bradycardia): যখন হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ধীর হয়, যার ফলে ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

হার্ট ব্লক (Heart Block): যখন হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো সঠিকভাবে এক চেম্বার থেকে অন্য চেম্বারে পৌঁছাতে পারে না।

সিক সাইনাস সিন্ড্রোম (Sick Sinus Syndrome): এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদপিণ্ডের প্রাকৃতিক পেসমেকার (সাইনাস নোড) সঠিকভাবে কাজ করে না, ফলে হৃদস্পন্দন খুব ধীর, খুব দ্রুত বা অনিয়মিত হতে পারে।

সাইনাস অ্যারেস্ট (Sinus Arrest): যখন হৃদপিণ্ড সাময়িকভাবে স্পন্দন বন্ধ করে দেয়।

হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure): কিছু নির্দিষ্ট ধরণের হার্ট ফেইলিউরের ক্ষেত্রে, বাই-ভেন্ট্রিকুলার পেসমেকার (CRT) হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।


কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

• আধুনিক পেসমেকার ব্যাটারি ৮-১৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়

• MRI বা মোবাইল ফোনের কিছু মডেল পেসমেকারের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলতে পারে, তাই সচেতন থাকতে হয়

• প্রতিস্থাপনের পর নিয়মিত ফলোআপ ও পরীক্ষা জরুরি

• অধিকাংশ রোগী পেসমেকার লাগানোর পর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন


উপসংহার

পেসমেকার স্থাপন একটি নিরাপদ এবং কার্যকর পদ্ধতি, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সাহায্য করছে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে একজন পেসমেকারধারী রোগীও দীর্ঘ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন ইনশাআল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.